পরিচিতি জহর দেবনাথ।
পিতা : যোগেন্দ্র দেবনাথ। মাতা : সরোজনী দেবী।
জন্ম : ১৯৬২ সনের ১৯শে সেপ্টেম্বর, ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলার লালছড়ী গ্রামে।
শিক্ষা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ, বি এড।
সাহিত্য কর্ম : ছাত্র জীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ।ছাত্র জীবনে পদ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে ছোট গল্প এবং উপন্যাস লেখাতেই সাবলীল। লিখেছেন অনেক কবিতা ও।
এরই মধ্যে লেখকের ছয় টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আর প্রতিটি উপন্যাস ই পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচিত, সমালোচিত এবং সমাদৃত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের জন্য দুটি গল্প সংকলন এবং বড়দের তিনটি গল্প সংকলন।
বিগত একুশ বছর ধরে প্রবাহ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা এবং প্রকাশ করে আসছেন।
সম্পাদনা করেছেন দুটি কাব্য গ্রন্থ এবং একটি গল্প গ্রন্থ ও।
সাহিত্য সংগঠন ধলাই সাহিত্য পরিষদ এর সম্পাদক।
বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য সাময়িকীর নিয়মিত লেখক।
একজন সফল নাট্যকার,নির্দেশক এবং অভিনেতা।
ধলাই জেলার অন্যতম সমাজ সেবী সংস্থা প্রবাহ ধলাই এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক। বিশিষ্ট একজন সমাজ কর্মী।
পেশা : সরকারী বিদ্যালয় এর শিক্ষক এবং দীর্ঘদিন যাবত সরকারী কর্মসূচি- সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলনের অন্যতম কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রশ্ন:
আপনার শুরুর দিনগুলো শুনবো?
লালছড়ি গ্রামের অখ্যাত এক পাড়ায় আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন একজন প্রান্তিক চাষী। আমরা পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে আমি সর্ব কনিষ্ঠ। ছোট বেলা থেকেই দারিদ্রতার সঙ্গে আমার লড়াই। উত্তর লালছড়ী নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে আমার শিক্ষা জীবনের শুরু। আমার মা বাবার তথাকথিত বিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে ও, আমার বাবা নিজের চেষ্টায় বাল্য শিক্ষা, শিশু শিক্ষার বই পড়তে শিখেছিলেন।আর সেই থেকেই রমায়ণ, মহাভারত এবং পদ্মাপুরান কাব্যগুলি অনায়াসে পড়তেন।বাবা দারুন মিষ্টি সুরে পয়াড় ছন্দে কাহিনী গুলো পড়তেন,আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।বাবা কাহিনী গুলো সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করতেন।আর এ ভাবেই সাহিত্য বা কাহিনীর প্রতি আমার আকর্ষণ বা আগ্রহ। মনে মনে ভাবতাম, একদিন বড় হয়ে পড়া লেখা করে আমিও আমাদের সমাজের জীবন কাহিনী নিয়ে একটা কিছু কাব্য লিখে ফেলবো।
আর এ ভাবেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে কুলাই দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়ে এলাম উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকার সময়েই আমাদের বিদ্যালয় থেকে ঠাকুমার ঝুলি র মতো অনেক রূপকথার গল্পের বই পড়তে শুরু করি।যখন আমি অষ্ঠম শ্রেণীর ছাত্র তখনই কবিতা লিখতে শুরু করলাম চুপি চুপি। আমাদের বাংলা পড়াতেন সবার প্রিয় স্বপ্না ( ভট্টাচার্য) দিদিমণি ।প্রিয় দিদিমণির কাছ থেকেই কবিতা লেখার প্রথম অনুপ্রেরণা। ছাত্র জীবনে আমার আদর্শ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কবি সুকান্তের কবিতা আমায় ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করে।কবির কবিতা অনুকরণ করে কবিতা লিখতে শুরু করি। বহুকষ্টে পয়সা জমিয়ে একটা খাতা কিনেছিলাম। তখন তো স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় লেখার খাতা ই ঠিক মতো পেতাম না। কবিতা লেখার জন্য খাতা তো আমার কাছে বিলাসীতা!দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় অল্প কয়েক দিনের জন্য কবি পীযুষ রাউত স্যার কে বাংলার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। উনাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। উনার কন্ঠে কবিতা আবৃত্তি আমাকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করে। পরবর্তী সময়ে বাংলার শিক্ষক প্রীতিবিকাশ দে স্যার আমার কবিতার খাতাটি অনেক ঠিক ঠাক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত আফসোস যে প্রথম জীবনের সেই কবিতার খাতাটি কোথায় যে আত্ম গোপন করল!
আমাদের পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েত সচিব বিষ্ণু দেববর্মা ছিলেন একজন সাহিত্য প্রেমি মানুষ।
উনার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আনন্দ মেলা, শুকতারা এবং নবকল্লোলের মতো সাহিত্য ম্যাগাজিন পড়া শুরু। এবং স্বপ্ন দেখা শুরু বড় হয়ে বড় একজন কথাসাহিত্যিক এবং সম্পাদক হবো।আর এই ভাবেই প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য জগতে আমার বিচরণ করা।
একসময় কলেজ পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড. পড়াশোনা করতে গিয়ে আমার স্বপ্নের জগৎ আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। ততদিনে সাহিত্য জগতের আরো গভীরে আমার বিচরণ শুরু।আপনারা সবাই জানেন নব্বই দশকের শুরুতে আমাদের রাজ্যে একটা অস্বাভাবিক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল।যে অস্থিরতা অন্যান্যদের মতো আমাকেও একটু অন্যরকম ভাবে ভাবিত করে।আর সেই তাগিদ থেকেই গদ্য সাহিত্যে আমার পথ চলা শুরু। লিখতে থাকি একের পর এক এক গল্প। আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় কমলপুরের হালহালি থেকে প্রকাশিত সজল আচার্য্য সম্পাদিত শকুন্তলা ম্যাগাজিনে। পরবর্তীতে ত্রিপুরা দর্পন পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে আমার গল্প। আর এ ব্যাপারে আমি শ্রদ্ধেয় পুলক দাদার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তৎকালীন সময়ে এমন কিছু বাস্তব ঘটনার উপর এমন কিছু গল্প আমি লিখে ছিলাম,যে গুলো আমার স নামে প্রকাশিত হলে হয়তো আমি জহর দেবনাথ সন্ত্রাসের শিকার হতে পারতাম।তাই পুলকদা আমাকে সুন্দর একটি ছদ্ম নাম দিয়েছিলেন।আর ঐ নামে অনেক সংকটের গল্প প্রকাশিত হয়।যা নাকি একসময় পাঠক মহলে বেশ আলোচিত হয়েছিল। অবশ্য এখনো ঐ ছদ্ম নামে ও লিখে থাকি।ছদ্ম নামটি এখনই না হয় নাই বা বললাম।কারণ আমার মনে হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি তে দাঁড়িয়ে ও স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমরা এখনো পাইনি। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়, তখনকার সময়ে আমাকে গল্প লেখায় উৎসাহিত করতেন এবং লেখার ভালো মন্দ নিয়ে আলোচনা করতেন আমার ভাইপো,কলেজ শিক্ষক শ্রীনিবাস দেবনাথ।
যাই হোক আপনি জানতে চেয়েছিলেন আমার পথচলার শুরুর কথা। বলতেই হয় তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরা দর্পন পত্রিকার পাশাপাশি দৈনিক সংবাদ এবং ডেইলি দেশের কথা পত্রিকার কাছে ও আমি কৃতজ্ঞ। এই দুটি পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে ও নিয়মিত ভাবে আমার গল্প কখনো বা কবিতা প্রকাশিত হতো।আর আমার এই লেখা  সমৃদ্ধ হয়ে উঠার পেছনে শ্রদ্ধেয় কৃত্তিবাস চক্রবর্তী এবং বিজয় পাল দাদা আমাকে সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন।
এবার আসছি আমার সম্পাদক হয়ে উঠার গল্পে। আমাদের অঞ্চলের বিশিষ্ট সাহিত্য প্রেমি এবং কবি পংকজ চক্রবর্তী মহাশয়ের হাত ধরেই আমার সম্পাদনার পথ চলা শুরু। প্রথমে হাতে লেখা দেয়াল ম্যাগাজিন প্রবাহ দিয়ে শুরু। দীর্ঘদিন হাতে লেখা প্রবাহ সম্পাদনা করার পর ছাপার অক্ষরে প্রবাহ প্রকাশিত হতে থাকে।এবারে যার বাইশ তম সংখ্যা প্রকাশিত হবে।
লেখক হিসেবে বা সম্পাদক হিসেবে কী করতে পেরেছি বা পারেনি সেটা সময়েরই বিচার করবে ‌। তবে আমি মনে করি এটাই আমার কাজ,আর এই কাজটা আমি আমৃত্যু পর্যন্ত করে যেতে চাই। আপনাদের শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা ই আমার পাথেয়।
প্রশ্ন :২
আপনাকে পেয়েছি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে,সম্পাদনায়।প্রকাশনায়ও আপনার অবদান আছে।এই বিষয়গুলো কেমন করে সামলে আবার শিক্ষকতাও করেন?
উত্তর :
  শিক্ষক হওয়ার আগে থেকেই আমি একজন শিক্ষানবিশ সম্পাদক এবং সাংবাদিক। তখন অবশ্য হাতে লিখে দেয়াল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম। সেই সঙ্গে ত্রিপুরার অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি দেশের কথা র সাংবাদিক ছিলাম। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পর থেকেই ছাপার অক্ষরে প্রবাহ ম্যাগাজিন সম্পাদনার কাজ শুরু। পাশাপাশি শিক্ষকতার জীবনের শুরুতেই ঘটনা চক্রে আমি ত্রিপুরার গ্রাম পাহাড়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচির দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি। সরকারি ভাবেই আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় ‌আর এই কাজে যুক্ত হয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অনেক কিছু জেনেছি, বুঝেছি, উপলব্ধি করেছি।যা আমাকে জীবনের চলার পথে সমৃদ্ধ করেছে। সরকারি চাকরি জীবনে বলুন বা পারিবারিক জীবনে কিংবা সমাজ জীবনে কি ভাবে ম্যানেজমেন্ট প্রয়োগ করতে হয় তা শিখেছি। পাশাপাশি প্রবাহ ধলাই নামে একটি সেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালনা করতে গিয়ে ও সমৃদ্ধ হয়েছি।
আমি শিখেছি যে আন্তরিকতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সঙ্গে কাজ করলে মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে।এটা আমার জীবনের অভিজ্ঞতা।আর এটাই আমার চলার পথের মূল মন্ত্র। আমি সমাজে একটা প্রগতিশীল পরিবর্তন চাই।আর এ জন্যই আমি এই লিটল ম্যাগাজিন কে হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিলাম। আমি চাই, স্বপ্ন দেখি এই লিটল ম্যাগাজিন আগামী দিনে সমাজ পরিবর্তনের একটা হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
প্রশ্ন :৩
ত্রিপুরার প্রকাশনা জগতে প্রবাহ প্রকাশন কিরকম কাজ করতে চান?
উত্তর :
 প্রকাশনা কেবলমাত্র একটি শিল্প ই নয়, প্রকাশনা এমন একটি মাধ্যম,যার মাধ্যমে বর্তমান এবং আগামী সমাজের কাছে ভালো একজন বন্ধু কে উপহার দেওয়ার যায়। অর্থাৎ কিনা সভ্যতার ইতিহাস ও কাহিনী যার কাছে লিপিবদ্ধ করা হয় সেই বই কিন্তু প্রকাশনার মাধ্যমেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং আমি চাই ছোট্ট পরিসরে সৃষ্টি করা আমার প্রবাহ প্রকাশন শুরুতে ধলাই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবি সাহিত্যিক দের সাহিত্য কর্ম পাঠকের হাত তুলে দেবে। এবং ইতি পূর্বেই এই কাজটি আমরা শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি আগামী দিনে ও আমরা আরো নতুন নতুন সৃষ্টি নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হতে পারবো। তবে একক ভাবে আমার দ্বারা অমন একটা কর্মকাণ্ড কে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না।তাই আমরা সবাই মিলে সমবায় ভিত্তিতে কাজটাকে এগিয়ে নিতে চাই।
প্রশ্ন :৪
ত্রিপুরার প্রকাশনা জগতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হোক।তাতে ধলাইকে যুক্ত করতে হবে।এ বিষয়ে আপনার অবদান আরো দৃপ্ত হোক।কি ভাবছেন?
উত্তর  :
 এ ব্যাপারে আপনার সাথে আমি একশো শতাংশ একমত। দীর্ঘ সময় ধরে যে সব প্রকাশনা সংস্থা কাজ করছেন, নিশ্চিত ভাবেই ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প কে তারা দারুন একটা জা’গায় উন্নিত করেছেন। পাশাপাশি আমি আন্তরিক ভাবেই চাইছি নতুন নতুন আরো ধারা যুক্ত হোক, অর্থাৎ কিনা নব আঙ্গিকে নতুন করে জোয়ার আসুক।আর সেই জোয়ারে আমরা ও ভেসে যেতে চাই। আমার পুরো টা দিয়েই আমি চেষ্টা করছি এবং করবো।
প্রসঙ্গত একটি কথা বলি, আমাদের ধলাই জেলার সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার একটা ঐতিহ্যময় অতীত রয়েছে। কিন্তু সংগঠিত ভাবে সাহিত্য বা প্রকাশনা শিল্প নিয়ে অতীতে তেমন করে কেউ ভাবে নি বা প্রয়োজন বোধ করেন নি। সেই অভাব টা আমরা ভীষণ ভাবেই বোধ করছি। তাইতো আমি এবং আমরা কয়েকজন চাইছি ধলাই জেলাতেও প্রকাশনা শিল্প নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিক।
প্রশ্ন :৫
আপনি সংগঠক।আপনি কথাকারও।পরস্পর বিরোধিতা হয়?
উত্তর :
দেখুন এ ব্যাপারে একটি কথা চিরন্তন সত্য যে,ধন্দ, বিরোধীতা, মতানৈক্য এ গুলো ছিল আছে এবং থাকবে ও।আর এভাবেই নতুন শুভ বা মৌলিক- প্রগতিশীল  একটা কিছু সৃষ্টি হবে। তেমনি ভাবে একাধিক ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে কথাকার জহর দেবনাথ একাধিক বার বিরোধিতার সন্মুখীন হয়েছি।আর সেই বিরোধিতা এবং সমালোচনা আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে।আর সেই ভাবনা থেকেই নতুন নতুন দরজা আমার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে।
প্রশ্ন :৬
ধলাই জুড়ে কান পাতলে জহর দেবনাথ একাই একশ।বিষয়টিতে অর্থাৎ এই কর্মযজ্ঞে কেমন করে এলেন?
উত্তর :
জহর দেবনাথ একাই একশো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। হয়তো আপনারা আমায় একটু বেশিই ভালোবাসেন,তাই এমন করে বলছেন। তবে আপনাদের এই ভালোবাসা কে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি,প্রথম দিকে আমি ও অন্যান্য দের মতো সাহিত্য জগতে নিজস্ব একটা পরিচিত গড়ে তোলতেই ব্যস্থ ছিলাম। কিন্তু স্থানীয় ভাবে আমাদের ধলাই জেলায় সার্বিক ভাবে সাহিত্য এবং সাহিত্যিক দের নিয়ে কিছু একটা করার মতো উদ্যোগ তেমন ভাবে নেই।না সরকারি না বেসরকারি। সেই তুলনায় নাচ গান ছবি আঁকা নিয়ে যেমন একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তেমনি সরকারি ভাবে ও বিভিন্ন ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। কোন এক অজ্ঞাত রহস্যময় কারণে সাহিত্য টাকে সংস্কৃতি জগতের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বরা ও এড়িয়ে চলেন। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে সঙ্গীত নৃত্য বা চিত্র জগতের ব্যক্তিদের আমন্ত্র জানানো হলেও সাহিত্য জগতের কাউকে ডাকা হয় না।
তখনই মাথায় আসে ধলাই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, বিচ্ছিন্ন ভাবে যারা সাহিত্য চর্চায় ব্রতি আছেন, তাদের নিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলা। ক্ষেত্র মোটামুটি প্রস্তুতই ছিল। কারণ এরই মধ্যে আমাদের প্রবাহ ম্যাগাজিন এবং প্রবাহ ধলাই সংস্থার মাধ্যমে কবি সাহিত্যিক দের নিয়ে সাহিত্য আড্ড, আলোচনা, সাহিত্য রচনা প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছিলাম।আর এই যে কর্মকাণ্ড চলছে তার কৃতিত্ব কিন্তু আমার একার নয়, আমাদের একটা সক্রিয় টিম রয়েছে। তবে হাঁ সবাই মিলে আমাকে এই টিমের নেতৃত্বের দায়িত্ব টা তুলে দিয়েছে।আর আমি শুরু থেকে এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি সবার সহযোগিতায় সেই দায়িত্ব টা ঠিক ঠাক ভাবে পালন করতে।
আর এ ভাবেই সময়ের দাবী তে ২০১৬ সালে আমরা গড়ে তুললাম ধলাই সাহিত্য পরিষদ।আর এখন এই ধলাই সাহিত্য পরিষদ এবং প্রবাহ ধলাই সংস্থা যৌথ ভাবে অন্যান্য কর্মসূচির পাশাপাশি গুরুত্ব সহকারে সাহিত্য এবং প্রকাশনা কর্মসূচি টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
প্রশ্ন :৭
আপনার সাহিত্য চর্চায় বর্তমানে প্রধান বিষয় উপন্যাস। এ পর্যন্ত উপন্যাস লিখে কেমন তৃপ্ত আপনি?
উত্তর :
না আমি এখনো তেমন ভাবে তৃপ্ত হতে পারিনি। কারণ এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-ভাবনা মাথায় রয়ে গেছে যে গুলোর লিপিবদ্ধ রূপ দেওয়া যে অনেক বাকি! কবে নাগাদ তৃপ্ত হবো বা আদৌ হতে পারবো কিনা জানিনা।
প্রশ্ন :৮
সাম্যবাদ আপনার সেরা উপন্যাস। স্রোত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত। এই উপন্যাস বিষয়ে আপনার মতামত কি?
উত্তর :
সেরা উপন্যাস কি না, সেটা ভেবে দেখিনি। তবে নিশ্চিত ভাবেই আমি আমার ভাবনা এবং অভিজ্ঞতার সেরা টা দিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। ‌আমি বিশ্বাস করি না যে,কোন একটা ছক বাঁধা নিয়মের মধ্যেই ভাবনা এবং ভাবনার বহিঃ প্রকাশের কায়দা টা সীমাবদ্ধ থাকবে।কর্ম জীবনে বেশ একটা সময় আমি গ্রাম পাহাড়ে সাধারণ নিরক্ষর মানুষদের সঙ্গে কাটিয়েছি। উনাদের সুখ দুঃখ অভাব অভিযোগ ভাবনা ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি। সাধারণ মানুষদের আবেগ আর স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বরা কি ভাবে ছেলে খেলা করে তা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি।হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি সমাজ এবং সমাজের মানুষদের নিয়ে মহান দার্শনিক দের ভাবনা কে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বরা কীভাবে  নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করছে! কিন্তু সময় বড়ই নির্মম।সে কোনদিন কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আর সেই চিত্রটাই আমি আমার সাম্যবাদী উপন্যাসে তোলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কতটা সফল হয়েছি সেটাও সময় ই ঠিক করবে। তবে আমি বিশ্বাস করি পাঠকরা এই উপন্যাস টি হাতে নিলে হতাশ হবেন না। সন্মানিত পাঠক বন্ধুদের কাছে ‌আবেদন রইলো বই টি একবার পড়ে দেখবেন। এর মধ্যেই উপন্যাস টি বিদগ্ধ জনদের কাছে যেমন প্রশংসিত হয়েছে তেমনি সমালোচিতও হয়েছে যথেষ্ট।
সবশেষে স্রোত প্রকাশন কে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার এই সাম্যবাদী উপন্যাসটি পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন :৯
নদী কেন্দ্রীক উপন্যাসও আপনার আছে।সম্ভবত স্রোত প্রকাশনা থেকে প্রকাশ হবে।পাণ্ডুলিপি দিয়ে রেখেছেন।প্রচ্ছদও ছাপা হয়ে আছে।একটু আলোকপাত হোক।
উত্তর :
 আপনি ঠিক বলেছেন, নদী কেন্দ্রীক একটি প্রেমের উপন্যাস ‘নদী থেকে হৃদয়ে’ স্রোত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হওয়া টা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা । ‌আমরা সবাই জানি আমাদের প্রতিবেশী বরাক উপত্যকার প্রধান নদী বরাক।আর সেই বরাক নদীর পারের এক অভিজাত পরিবারের একমাত্র কন্যার সঙ্গে বরাক নদীতে ভেসে আসা অজ্ঞাত কুলশিল এক যুবকের হৃদয়ের সম্পর্ক।আর সেই হৃদয়ের সম্পর্ক কে  কেন্দ্র করেই জাতি ধর্ম  ইস্যু কে সামনে এনে দুটি যুবক যুবতীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ। সেই সঙ্গে রয়েছে মানুষের মানসিক এবং সামাজিক সংঘাত। কিন্তু আমি মশাই ” মানুষ মানুষের জন্য —-” আদর্শে বিশ্বাসী।
এই হচ্ছে আমার ‘ নদী থেকে হৃদয়ে’ উপন্যাসের মূল ভাবনা ‌,যা নাকি স্রোত প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হবে। আমি আশাবাদী এই উপন্যাস টি ও পাঠকদের মন জয় করতে সফল হবে।
প্রশ্ন :১০
ধলাই সাহিত্য উৎসব এর আপনি রূপকার।প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি বিষয়ে বলুন।
উত্তর :
  আসলে কি জানেন গোবিন্দ বাবু, আমি স্বপ্ন দেখতে ভীষণ ভালোবাসি।আর সেই স্বপ্নের ভালোবাসা কে বাস্তবায়িত করতে আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করি ‌।আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগেই ভাবনায় এল যে, আমাদের সমাজে তো সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে অনেক রকমের মেলা বা উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে তো কেউ ভাবছে না!এই ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নিলে কেমন হয়! সাহিত্য নিয়ে ছোট বড় সব ভাবনাই আমি শ্রদ্ধেয় কবি নিশীথ রঞ্জন পাল দাদার সাথে আলোচনা করি।এই সাহিত্য উৎসবের ভাবনা নিয়ে আলোচনা করায় উনি আমাকে উৎসাহিত করলেন। সেই থেকে শুরু।বেশ কিছু দিন ভাবনা, স্বপ্ন দেখতে দেখতে ২০১৭ সালের ৯ই এপ্রিল স্বপ্নের প্রথম রূপদান।
ধলাই সাহিত্য উৎসব বাস্তবায়িত করতে গিয়ে অনেক প্রতিকূলতার সন্মুখীন যেমন হয়েছি, তেমনি অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা ও পেয়েছি।এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। প্রতিকূলতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের রাজ্যের অন্যান্য জেলা তথা বহিঃ রাজ্যের, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক এবং সাহিত্য কর্মীদের সঙ্গে আমাদের এই ধলাই জেলার একটা যোগসূত্র গড়ে উঠেছে ‌।  সুতরাং সবটাই আমার এবং আমাদের কাছে বিরাট প্রাপ্তি।
প্রশ্ন:১১
আপনি কবিতাও লেখেন মাঝে মাঝে। লেখেন নিয়মিত গল্পও।এ যাবৎ প্রকাশিত গল্পগুলো লেখে আপনি তৃপ্ত?
উত্তর  :
 আমি আগে ও বলেছি কবিতা দিয়েই সাহিত্য জগতে আমার বিচরণ শুরু। পরবর্তীতে গল্প নিয়ে কাজ।বেশ কয়েকটি গল্পে সময়ের ছবি আঁকতে পেরে আমি তৃপ্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু সময় যে পরিবর্তনশীল! সুতরাং বর্তমান পরিবর্তিত সময়কে তো সে ভাবে সাহিত্যে তুলে ধরতে পারছি না!অতএব অতৃপ্তি তো থেকেই যাচ্ছে—-
প্রশ্ন :১২
আপনার সাহিত্যে এই সময়ের ছবি আসে।সময়কে আপনি কিরকম দেখতে চান?
উত্তর :
দারুন একটা প্রশ্ন করলেন,যার উত্তর এক কথায় দেওয়া আমার পক্ষে বড় কঠিন।কেন না সময় বড় রহস্যময়!সে আপন খেয়ালে চলে। এই একটা জায়গায় আমরা এখনো বড় অসহায়।সময় বা কাল এতটা সত্য এবং বাস্তব যে সে কাউকে পরোয়া করে না। সৃষ্টির আদি কাল থেকেই সে তার আপন নিয়মে চলে আসছে। ইতিহাস সাক্ষী যে বহু  পরাক্রমশালী শাসক বা সাম্রাজ্য ও কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে বা ইতিহাসের পাতায় কলংকিত হয়ে আছে।
অবশ্য উত্থান পতন এটাই তো সময় বা কালের নিয়ম। সময়ের গতি, সময়ের অতীত -বর্তমান বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের ছবি আঁকাই তো কবিতা এবং সাহিত্যের কাজ! কবি সাহিত্যিকরা হচ্ছেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্ঠা। যত কঠিনই হোক না কেন বাস্তব সত্যটাকে তুলে ধরাই তো তাদের কাজ ‌!
 কিন্তু সেই কাজটা তাঁরা ঠিক ঠাক ভাবে করছেন কী!বা আমরা করতে পারছি কী! বেশির ভাগ সময়েই কাউকে না কাউকে খুশি রাখতে বা খুশি করতেই আমরা সাহিত্য চর্চায় ব্রতি হই।এটা বড়ই বেদনা দায়ক।তার মানে সবাই এমনটা করছেন এমনটা কিন্তু আমি বলছি না। অনেকেই আপসহীন ভাবে বাস্তব সময়টা কে তুলে ধরছেন।আর আমিও তাঁদেরই একজন অনুগামী। অন্যন্যা নামে আমার একটি গল্প এবার পূজোর সংখ্যায় প্রকাশিত হবে, পড়ে দেখবেন। বর্তমানের এন.আর.সি.এবং ডিটেনশন ক্যাম্প নামক মানব খোয়ারের কাহিনী নিয়ে আমার এই লেখা।  আমার অতৃপ্তিটা এখানেই যে এমন আরো অসংখ্য প্রবহমান সময়ের ঘটনা রয়েছে যে গুলোর ছবি আঁকতে পারছিনা।
Source-banglabhasha.sahityo.in