একদিন এক সন্ধ্যা রাতে, মদিরার আসর তখন মধ্য গগনে বলা যায়, চার বন্ধুতে আসর মাতিয়ে তুলেছি।এমন সময় আচমকাই এক বন্ধু বেমাক্কা অদ্ভূত এক প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। অবশ্য এই বেটাকে আমার বন্ধু বলবো না শত্রু সেটাই আজ পর্যন্ত ঠিক ঠাক বুঝে উঠতে পারছি না । জীবনের চলার পথে এই মানুষটি কে ছাড়া আমার চলে না, আবার এই বেটাই আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক। আমার ভালো কাজের যেমন প্রশংসা করে তেমনি আবার সামান্য একটু সুযোগ পেলেই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।এক কথায় কট্টর সমালোচক যাকে বলে। হয়তো বা অনেকেই আমার এই বন্ধু রত্ন টিকে চেনেন বা জানেন।সে হলো বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং সাহিত্য সমালোচক শ্রী মান নিমাই বারুই।
আজ ও অমন একটা রঙিন আসরে আমাকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করে।দু পেগ পেটে যেত না যেতেই আসরে নেমে পরে।
‘ও হে সাহিত্যিক মশাই, দিনের পর দিন দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট করে,সমাজ সংসার কে বঞ্চিত করে কলম নিয়ে মেতে আছো।তা ব্রাদার বলো দেখিনি এতো সব লেখা লেখি কেন কারো ! কী হবে এতো সব লিখে! মাঝখান থেকে বৌদি কে সংসার কে অনেক আনন্দ স্ফূর্তি থেকে বঞ্চিত করছো !’
বন্ধুর কথা শুনে চমকে উঠলাম। তাই তো!ব্যাপারটা ভাববার মতোই বটে। আমার এই লেখা লেখির জন্য নিজের বৌ এমনকি আত্মিয় সজন দের কাছ থেকেও অনেক অভিযোগ- ইয়ার্কি ঠাট্টা শুনতে হয় বৈ কি। কিন্তু তা বলে এমন একটা আক্রমনের মুখে কোন দিন পড়িনি। কিন্তু আমি ও ছেড়ে দেবার পাত্র নই। আমার বৌ প্রায়সই বলে আমি নাকি সাংঘাতিক চোপা খোর, কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। আমার চোপার নাকি সাংঘাতিক জোড়। অবশ্যই আবার এটাও বলে তোমার সঙ্গে কথার যুক্তি তে আমি পেরে উঠতে পারিনা।
সে যাই হোক,ধান ভাঙতে শিবের গীত গেয়ে আপনাদের বিরক্ত করবো না।তবে একজন সমাঝদার সাহিত্য সমালোচক এর কাছ থেকে এমন একটা আক্রমনে আমি প্রথম টায় একটু চমকেই উঠেছিলাম। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিই।
‘ ভায়া তুমি দারুন একটা কথা বললে তো! কেন নিজের এবং পরিবারের সময় নষ্ট করে লেখা লেখি তে মজে থাকি! তা ব্রাদার তুমি কেন আমাদের আমন্ত্রে সারা দিয়ে এই মদিরা পানের আসরে অংশ গ্রহণ করতে এলে?’
‘ আরে এটা আবার নতুন করে বলার কী আছে! এই যে আসরে এলাম, তোমাদের সঙ্গে দেখা
হলো, রঙিন সুরা পান করে মনের আনন্দ পাচ্ছি, নতুন করে উদ্যম পাচ্ছি,কাল থেকে ই নিজের প্রফেশনাল কাজে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বো।এটা কি কম না কি!’
‘ বেশ বুঝলাম সুরা পান করছ মন কে উজ্জিবিত রাখতে।তা ব্রাদার এই যে মাংস আর রুটি ও খাচ্ছ সেটা কেন!’ আমার এই কথা টা শুনে বন্ধু বর হো হো করে হেঁসে কুটি কুটি।
‘ আরে ভাই তুমি কি ছেলে মানুষের মতো কথা বলছ।আরে রুটি ভাত মাছ মাংস সবজি এই সব না খেলে শরীর টিকবে কেন!আর শরীর না টিকলে তোমার অস্তিত্বই যে বিপন্ন হতে বসবে।’
‘ ঠিক বলেছ,আর ঠিক এই কারণেই আমি অর্থ এবং সময় নষ্ট করে লিখে আসছি, লিখছি এবং আগামী দিনে ও লিখবো।’
আমার উত্তর টা শুনে আমার কট্টর সমালোচক বন্ধু বর থমকে যায়। নেশার ঘোরে কি না জানি না,বড় বড় চোখ করে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে ওর রা টি নেই। কিন্তু আরো যে দুই বন্ধু মনযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল, তাদের মধ্যে একজন বললো- ‘ দোস্ত একটু ঝেড়ে কাশ তো।’
‘কেন দোস্ত আমি দূর্বুদ্য ভাষায় তো কিছু বলিনি।’
‘তা হয়তো নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার কথাটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।’
‘বেশ তবে বলি শুন – প্রথম কথা হচ্ছে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ক্রীড়া এই সব কিছুই কিন্তু মানুষের মন এবং শরীরের বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। সেই হিসেবে আমি ও কিন্তু ছোট-বড় সবার মনের এবং শরীরের খোরাক এবং সার্বিক সুস্থ বিকাশের লক্ষ্যে ই সাহিত্য নিয়ে কাজ করি। বলতে পারো কৃষকের কৃষি চাষের মতোই শব্দ বা সাহিত্য চাষের কাজ করি মানবের মনের খোরাক জোগাতে।’
‘ ওরে বাপরে, এভাবে তো ব্যাপারটা নিয়ে কোনদিন ভাবিনি।’
‘ আরে ইয়ার এতো আশ্চর্য হচ্ছো কেন! এতো গেলো আপাত দৃষ্টিতে বাইরের দিকটা।’
‘ তার মানে এর ভেতরে ও আবার কিছু আছে নাকি!’
‘ নিশ্চয়ই আছে, আমি তো তাই মনে করি।’
‘ বেশ, তবে শুনাও তোমার মনের কথা।আজ এর একটা ফয়সালা হয়ে যাক।’
‘ নিশ্চয়ই বলবো,এর আগে এমন করে আর কেউ জানতে চায়নি।আজ যখন তোমরা জানতে চাইছ তা হলে বলি শুন।’
‘ দেখ আমার শৈশব টা ও অন্য আর দশটা গ্রামের বাচ্চাদের মতোই কেটেছে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি একটু ব্যতিক্রম ছিলাম,সেটা হলো আমার একটা বাড়তি পাওনা-সেটা হচ্ছে, শৈশব থেকেই বাবার মুখে রামায়ণ মহাভারত এর কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হওয়া।আর তখন থেকেই ছোট্ট করে হলেও মনে বাসনার বীজ গেঁথে গেছিল যে বড় হয়ে আমিও একদিন দারুন একটা এত্তো বড় কাহিনী লিখবো। সেই থেকে শুরু। ঠাকুমার ঝুলি দিয়ে পড়তে শুরু করা। পরবর্তী সময়ে অকাল পক্ষের মতো কম বয়স থেকেই উপন্যাস পড়তে শুরু করা।আর সাহিত্য পড়তে পড়তেই সাহিত্য সৃষ্টিতে হাতে খড়ি।’
‘ আমার প্রায় সব ক’টা গল্প এবং উপন্যাসের প্লটই পেয়েছি আমি বাস্তব ঘটনা থেকে। অর্থাৎ কিনা বর্তমান সময়ে মানুষের সুখ-দুঃখ, বেদনা,মান অভিমান,অভাব অভিযোগ, ক্ষোভ বিক্ষোভ বিদ্রোহ এই সবকে পুঁজি করেই আমার লেখা।মানে এক কথায় আমি লেখার মাধ্যমে সময় টাকে ধরে রাখতে চাই।’
‘ মানুষের অনুভূতি গুলো আমাকে ভীষণ ভাবেই প্রভাবিত করে ।আর তখনই আমি কলম ধরি। মানুষ এবং মানব সমাজ তথা মানবের জীবন যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই আমি লিখি প্রেমের কথা, কখনো বিদ্রোহের কথা, কখনো বা স্বপ্নের কথা, কখনো বা সমাজে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর কথা। আমি মনে করি সাহিত্য শুধু মাত্র সমস্যা টাই তোলে ধরবে না, সেই সঙ্গে সমস্যা থেকে উত্তরণের ও একটা বৈজ্ঞানিক পথ দেখাতে হবে।এই ক্ষেত্রে লেখক, সাহিত্য এবং জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ।আর এই দায়বদ্ধতা থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে আমার লেখা। একদিকে যেমন বাস্তব জীবন চিত্র টা তুলে ধরতে চাই, পাশাপাশি শিশু থেকে প্রৌঢ় সবার মনেই নতুন করে স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে চাই। আমার অভিধানে হতাশার কোন স্থান নেই।’
‘ আমার কাহিনীর নায়ক নায়িকারা লড়াই করতে জানে,লড়াই করে নিজেদের প্রাপ্যটা আদায় করতে বদ্ব পরিকর।কোন অযৌক্তিকতা কিংবা অবিজ্ঞানে তারা বিশ্বাস করে না,ভাগ্যে ও বিশ্বাস করেনা। বাস্তব মাটির উপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন রচনা করে।আর আমার ঐ সব ভাবনাকে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে ধরাই আমার কাগজ কলম আর সময় খরচ করার একমাত্র লক্ষ্য।’
‘ আমি বিশ্বাস করি এক মাত্র বই ই পারে সমাজ সভ্যতাকে সঠিক পথের নিশানা দেখাতে।’